ডিজিটাল সেবা উপজেলার গুলোর প্রত্যন্ত গ্রামের চেহারা বদলে দিয়েছে


 ডিজিটাল সেবা উপজেলার গুলোর প্রত্যন্ত গ্রামের চেহারা বদলে দিয়েছে। নাগরিক সনদ, জন্ম নিবন্ধনের প্রমাণপত্র কিংবা অন্য কোন কাগজপত্রের জন্য এখন আর ইউনিয়ন পরিষদের বারান্দায় দিনের পর দিন অপেক্ষা করতে হয় না। অপেক্ষা করতে হয় না চেয়ারম্যানের সাক্ষরের। অনলাইনে দরকারি সকল সেবা পাওয়ায় মানুষের জীবনটাই যেন সহজ হয়ে গেছে।
এ চিত্র নওগাঁ জেলার বদলগাছী উপজেলার যমুনার তীরবর্তী ইউনিয়ন মথুরাপুরের। শুধুমাত্র ইউনিয়ন তথ্যসেবা কেন্দ্র কার্যকরভাবে চালু রেখেই এটা করা সম্ভব হয়েছে বলে জানালেন স্থানীয়রা। সরেজমিনে ওই কেন্দ্রে গেলে এলাকার মানুষ তুলে ধরেছেন ডিজিটালে ইতিবাচক পরিবর্তনের কথা।
দুর্গম জনপদের ইউনিয়ন তথ্য সেবা কেন্দ্রে তথ্য-প্রযুক্তির কল্যাণে ছেলের চাকুরি হয়েছে জানতে পেরে চোখে আনন্দাশ্রু ভ্যান চালক কুতুব উদ্দীনের। যথাসময়ে অনলাইনে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র পাঠাতে না পারলে ছেলেকে বাবার ভ্যান চালাতে হত। মথুরাপুর ইউনিয়নের জাবারীপুর গ্রামের জাফর আলম রাকিব বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড (বিজিবি)-তে সিপাহী পদে যোগদান করে দরিদ্র বাবাকে দুশ্চিন্তামুক্ত করেছে। আর এটা সম্ভব হয়েছে ইউনিয়ন তথ্য ও সেবা কেন্দ্রের কল্যানে।
মথুরাপুর ইউনিয়নের নালুকাবাড়ী গ্রামের কৃষক আবদুস সালাম এর ছেলে মোঃ ইব্রাহিমের বাংলাদেশ নৌবাহিনীতে যোগদানের সুযোগ পেয়েছে। কিন্তু তার সঙ্গে ছিল না নাগরিক সনদ। মংলা থেকে সকাল সাড়ে আটটায় ইব্রাহিম ঘটনাটি মোবাইলে ইউপি চেয়ারম্যানকে জানিয়ে সকাল ৯টার মধ্যে এই কাগজ হাতে পেয়েছে। ইউপি চেয়ারম্যান তাৎক্ষণিকভাবে নিজের সাক্ষর স্ক্যান করে নাগরিক সদন পাঠিয়ে দেন ই-মেইলে। এ দিয়ে নৌবাহিনীতে যোগদানের সুযোগ হয় ইব্রাহিমের।
মথুরাপুরের  কাদিমপুর গ্রামের হতদরিদ্র কৃষক আলমগীর হোসেনের ছেলে রাশেদ বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে চাকরি জন্য দাঁড়াবে। কিন্তু ইউপি চেয়ারম্যান ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। মোবাইলে বিষয়টি জানতে পেরে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সিল সাক্ষর করে ই-মেইলে ফেরত পাঠিয়ে দেন চেয়ারম্যান। রাশেদ পরের দিন লাইনে দাঁড়িয়ে সেনাবাহিনীতে যোগদানের সুযোগ পেয়েছে।
যমুনা পাড়ের এই ইউনিয়নের ডিজিটাল সেবা পৌঁছে গেছে দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিদেশে। ইউনিয়নের জাবারীপুর গ্রামের আলী করিমের ছেলে মামুন, একই গ্রামের কৃষক রুহুল আমিনের ছেলে প্রবাসী শ্রমিক ফারুক সৌদি আরবে কর্মরত অবস্থায় মারা যান। তাদের প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ইংরেজী ও আরবী ভাষায় অনুবাদ করে ই-মেইল এর মাধ্যমে সেদেশের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে পাঠানো হয়। খুব সহজে স্বজনের লাশ ও পাওনাদি বুঝে পায় পরিবার।
প্রত্যন্ত এলাকায় ডিজিটাল সেবার বহু উদাহরণের মধ্যে এগুলো কয়েকটি দৃষ্টান্ত মাত্র। বিচ্ছিন্ন জনপদের মানুষও যে অনলাইন সেবার প্রতি এতটা আকৃষ্ট হতে পারে, তার দৃষ্টান্ত মথুরাপুর।
সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, ইউনিয়ন পরিষদ ভবনের দোতলায় একটি কক্ষে তথ্যসেবা কেন্দ্রে কাজ চলে। কয়েকটি কম্পিউটার ও ল্যাপটপে কাজ করছে তিনজন তরুন। অনলাইনের নিউজ কিংবা উন্নয়ন তথ্য জানাতে এখানে প্রোজেক্টর ও বড় পর্দা রয়েছে। কেন্দ্রে সকাল, দুপুর, বিকেল সারাক্ষণই সেবা নিতে আসা মানুষের ভিড় থাকে।
শুধু তথ্যসেবা নয়, বহু ছেলেমেয়ে এখান থেকে কম্পিউটার শিখে নিজেদের চাকরি পাওয়ার পথ সুগম করে তুলছে। কেউ আবার ফেইজবুক চালানো থেকে কম্পিউটারের মাউস ধরা শিখে এখন ওয়েবসাইট তৈরিতে দক্ষতা অর্জন করেছে। ডিজিটালের কল্যানে গ্রামেই তৈরি হচ্ছে দক্ষ জনশক্তি। প্রত্যন্ত এলাকায় অবস্থান করলেও ইউনিয়ন তথ্যসেবা কেন্দ্রের কল্যাণে এখানকার মানুষ সার্বক্ষণিক সম্পৃক্ত থাকছে দূরের স্বজনদের সঙ্গে।
এই এলাকার বহু মানুষ বিদেশে অবস্থান করলেও স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগ তাদের কোন সমস্যা হচ্ছে না। প্রত্যন্ত এই গ্রাম থেকে বহু মানুষ বিদেশে থাকা স্বজনদের সঙ্গে স্কাইপিতে অনায়াসে কথা বলেন। খোঁজখবর নিচ্ছেন বাড়িতে রেখে যাওয়া মা-বাবা, বৃদ্ধ দাদা-দাদী, স্ত্রী-সন্তান পরিবারের সদস্য ও গ্রামবাসীর।
ইউনিয়নটি তথ্যসেবা কেন্দ্রে গিয়ে জানা গেল, বিদ্যুৎ না থাকলেও সৌর বিদ্যুতের মাধ্যমে দিনরাত ২৪ ঘন্টাই কেন্দ্রটি চালু রাখার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। হরতাল অবরোধে সড়ক যোগাযোগ বন্ধ থাকলেও কোন প্রভাব পড়েনা মথুরাপুরের প্রত্যন্ত পল্লীতে। সব কাজই চলে অনলাইনে। ছাত্র-ছাত্রীরা নওগাঁ, রাজশাহী, ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অনলাইনের মাধ্যেমে ভর্তির আবেদন ফরম পূরণ করতে পারছেন। চাকুরী প্রার্থী এমনকি শিক্ষক নিবন্ধনের জন্য আবেদন এখন মথুরাপুর গ্রামে থেকে করা যায় অতি সহজেই।
এই গ্রামের চাকুরীপ্রার্থীদের নিয়োগ পরীক্ষা, শিক্ষার্থীদের পাবলিক পরীক্ষার ফলাফল জানতে এখন আর কোন প্রকার বিড়ম্বনায় পড়তে হয় না। প্রতিষ্ঠান কিংবা কোন দপ্তরে দৌড়ঝাপ করতে হয় না। মথুরাপুর ইউনিয়ন তথ্য ও সেবা কেন্দ্রে পাবলিক পরিক্ষা ও নিয়োগ পরীক্ষার ফলাফল জানা এবং তা ডাউনলোড করে ফলাফলের প্রিন্ট কপি সংগ্রহ করা যায়।
ডিজিটাল সেবার মাধ্যমে ইউনিয়নের এই পরিবর্তনের নেপথ্য কারিগর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্দুর রহমান। যেন চব্বিশ ঘন্টাই জনপ্রতিনিধি তিনি। ভোরে ঘুম থেকে জাগতে না জাগতেই শুরু হয় এলাকার মানুষের নানান সমস্যার বিবরণ শোনা। সাধ্যমত সমাধান দিয়ে পরিষদ ভবনে যাওয়া। সকাল ৮ টায় ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ে গিয়ে নিজ হাতেই জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন। এরপর শুরু হয় অন্য কাজ।
ইউনিয়ন তথ্য ও সেবা কেন্দ্রে কম্পিউটার কম্পোজ করে সেবাগ্রহীতাদের বিভিন্ন কাগজপত্র সরবরাহ করেন চেয়ারম্যান নিজেই। পাসপোর্ট ফরম, বিভিন্ন দপ্তরে দরখাস্ত,নাগরিকসহ সকল ধরণের সনদ নিজে পূরণ করেন। গ্রাম আদালত ও অন্যান্য সুবিধা প্রাপ্তির জন্য ভূক্তভোগীদের দরখাস্ত নিজেই লিখে দেন। সরকারি ছুটি দুরে থাক শুক্রবারসহ সপ্তাহের সাতদিন সকাল ৮টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত ইউপি কার্যালয় খোলা রেখে দিনরাত কাজ করেন চেয়ারম্যান। ডিজিটাল সেবার নেশায় পড়ে থাকেন ব্যতিক্রমী এই জনপ্রতিনিধি।
কাজের স্বীকৃতি হিসাবে মথুরাপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সম্মানিত হয়েছেন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে। সামাজিক সংগঠন ও সাংবাদিকতার সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকে দু’যুগ ধরে জনসেবার স্বীকৃতি স্বরূপ পেয়েছেন চ্যানেল আই, জাতিসংঘের কৃষি ও খাদ্য সংস্থার পদক এবং উপকূলীয় সাংবাদিকতা পুরষ্কার।
মথুরাপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্দুর রহমান বলেন, এলাকার উন্নয়নে, মানুষের কল্যাণে জীবনের যেটুকু সময় ব্যয় করতে পারছি; তাই আমার কাছে মূল্যবান। মানুষ হিসেবে সৃজনশীল কাজ ও লেখালেখি করা, সৃষ্টিশীল ভাবনার মাঝে নিজেকে ব্যস্ত রাখা আমার দায়িত্ব। ডিজিটাল প্রযুক্তি এই সেবা অনেকটাই সহজ করে দিয়েছে।
এটি একটি রূপক নিউজ

Comments